কক্সবাজার জার্নাল ডটকম :
একাদশ সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে নৌকার টিকেটে এমপি হয়েছেন শাহীন আক্তার। সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির সহধর্মিনী গৃহিণী শাহীন আক্তার এর আগে রাজনীতিতে সম্পৃক্তই ছিলেন না। কিন্তু পিতা ও স্বামীর পরিবারের রাজনৈতিক হালচাল দেখেই সময় কেটেছে তার।
দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় আবদুর রহমান বদি স্ত্রীকে মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছিলেন। এসব কারণে জয় পেলেও গত পাঁচটি বছর তাকে মাঠে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের। তার (শাহীন আক্তার) হয়ে সকল কাজ সম্পাদন করেছেন দু’বারের এমপি অভিজ্ঞ বদি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও মনোনয়ন নিজের করতে পারেননি আবদুর রহমান বদি। ফলে এবারও নৌকার মাঝি হয়ে মাঠে এসেছেন বর্তমান এমপি শাহীন আক্তার।
তার সাথে মনোনয়ন জমা দিয়ে বাতিলের তালিকায় পড়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল বশর ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল আহমেদ বাহাদুর। তখন স্বাভাবিকভাবেই নৌকা নিযে শাহিন আক্তারের জয়টা সহজ হচ্ছে বলে রাজনীতির মাঠে হিসাব মিলিয়ে ছিলেন সবাই। কিন্তু সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে মনোনয়ন ফিরে পেয়ে মাঠে আসেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি নুরুল বশর। ঈগল প্রতীক নিয়ে নুরুল বশর মাঠে আসার পর পাল্টে গেছে ভোটের চালচিত্র। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
স্থানীয়দের মতে, দুদুকের মামলায় ৩ বছর সাজা হওয়ার পর আইনি জটিলতায় পড়ে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন অংশ নিতে পারেননি আবদুর রহমান বদি। কিন্তু থেমে থাকেনি তার রাজনৈতিক ম্যাজিক। মাঠে অখ্যাত ও অপরিচিত এবং শতভাগ গৃহিণী স্ত্রীকে দলীয় মনোনয়ন নৌকা প্রতীক এনে দিয়ে চমকে দেন। বদির মনোবল, বহুমাত্রিক পদচারণা, রাজনৈতিক কারিশমা, কৌশলে বিপুল ভোটে জয়পান শাহিন আক্তার। তবে এমপি হিসেবে কোন চমক বা সফলতা দেখাতে পারেননি তিনি। বলতে গেলে পুরো ৫ বছরই তিনি এলাকায় অনুপস্থিত এবং জনসম্পৃক্ততাহীন। এসময় বদির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উখিয়া-টেকনাফের বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন।
মাঠ গোছানো থাকায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন চান বদি। কিন্তু ২০১৮ সালের মতো এবারও আইনি জটিলতায় ছিটকে পড়ে অন্য দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পেছনে ফেলে নৌকার মাঝি করানো জয় বদির স্ত্রী শাহিন আক্তারকে।
তার সাথে শুরু হতে মাঠে ছিলেন, জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন চৌধুরি ভুট্টো (লাঙল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ফরিদুল আলম (আম), তৃণমূল বিএনপির মুজিবুল হক মুজিব (সোনালী আঁশ), ইসলামি ঐক্যজোটের মোহাম্মদ ওসমান গনি চৌধুরি (মিনার) ও বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ ইসমাইল (ডাব)। এসময় দলীয় এবং সাধারণ ভোটারগণ বদির সাথেই মাঠে নামেন। জয় সহজ দেখে প্রচারণায় তেমন গুরুত্বই দেয়নি বদি-শাহীন।
তবে, শুরুতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকলেও ২১ ডিসেম্বরের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে আসেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নুরুল বশর (ঈগল)। তিনি টিকে আছেন জেনে বদি বিরোধী এবং নরুল বশর সমর্থকরা ট্র্যাক পাল্টান। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে ঈগল প্রতীকের সমর্থকদের স্রোত। এতে নড়ে চড়ে বসেন রাজনীতির মাঠে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আবদুর রহমান বদি। নিজের মতো করে এলাকা গোছানোর পাশাপাশি মানুষের দ্বারে দ্বারে পাঠাচ্ছেন শাহীন আক্তারকে। সমানতালে উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে সবখানেই সরব উপস্থিতির জানান দিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছেন গত পাঁচ বছরে জনগণের মাঝে অনুপস্থিত বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আকতার।
ভোট বিশ্লেষকদের মতে, শাহীন আকতার ও নুরুল বশর দু’প্রার্থীই টেকনাফ পৌর এলাকার। এখানে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির প্রভাবের পাশাপাশি উখিয়ায় বাবার বাড়ি এবং ছোট ভাই জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় সেখানেও সমানে ভোট কব্জা করতে পারবেন তিনি। আবার স্বামী আবদুর রহমান বদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে ‘নিজ বলয়’এর অনেক বিদ্রোহীকে চেয়ারম্যান বানিয়েছেন। এ জন্য অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শাহীন আক্তারের বিরুদ্ধে মাঠে অবস্থান নিয়েছেন।
অপরদিকে, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতৃত্বের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদে নেতৃত্ব দেওয়া নুরুল বশর মাঠে আসায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। ওয়ার্ড থেকে উপজেলা সবখানেই নুরুল বশরের পরিচিত এবং কর্ম ততপরতা রয়েছে। তার ছোটভাই উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নুরুল আলম বর্তমানে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি ইতিপূর্বে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। উপজেলায় দু’ভাইয়ের গ্রহণযোগত্য সমান।
আবার, বশর উখিয়াতে পাচ্ছেন বদি বিরোধী সেন্টিমেট। ফলে, জয় নিজেদের মাঝে রাখতে বদি ও বশর নিজেদের কৌশলী লড়াই জমিয়ে তুলেছেন। সাথে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে আগামীতে সবার কাছাকাছি থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছেন বিনাশ্রমে ক্ষমতার মসনদে যাওয়া শাহীন আক্তার।
ভোটারদের মতে, শত বির্তক থাকার পরও তৃণমূলে মিশে থাকেন আবদুর রহমান বদি। আর একজন পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ছাত্রজীবন থেকে এলাকায় সময় দিয়ে আসছেন নরুল বশর। দু’জনই জনপ্রিয়। তবে, বউয়ের জয় নিশ্চিতে বদি ও নিজের কাজের মূল্যায়নটা বশর কিভাবে আদায় করেন সেদিকেই নজর সবার। কিন্তু যত যা-ই হউক বিনা চ্যালেঞ্জে ফসল ঘরে তোলা কারো পক্ষে সহজ হবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে, উখিয়া ৫ ইউনিয়ন থেকে যিনি বেশি ভোট আত্মস্থ করতে পারবেন, তিনিই জয়ের স্বাদ পেয়ে ইতিহাস গড়বেন।
এদিকে- নৌকার শাহীন আক্তার, ঈগলের নুরুল বশর ছাড়া নির্বাচনী মাঠে থাকা অপর ৫ জনের এলাকায় পরিচিতিও নেই। জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন সিকদার ভুট্টোর একসময়ের কলেজ শিক্ষক হিসেবে কিছুটা পরিচিতি থাকলেও জাপার প্রার্থী হিসেবে ভোটের ময়দানে তেমন প্রভাব নেই।এনপিপি’র ফরিদ আলম, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ ইসমাইলকে পাড়ার লোকজনও তেমন চেনেন না। ইসলামি ঐক্যজোটের রাজনৈতিক পরিচিতি থাকায় এদলের প্রার্থী কিছুটা ভোটের ময়দানে নড়াচড়া করছেন। তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মী কিংবা সাংগঠনিক ভিত্তিও দেখা মিলছে না। এসব প্রার্থী সব ভোট কেন্দ্রের এজেন্ট দিতে পারবে কিনা তাও সন্দেহ পোষণ করছেন সচেতন ভোটাররা।
স্থানীয়রা আরও বলেন, এআসনে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুর, প্রখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠান শাহপরী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহা ইয়াহিয়া, আবদুর রহমান বদির ছেলে দাবিকারী মোহাম্মদ ইসহাক। মনোনয়ন দৌড়ে এরা টিকে থাকলে শাহীন আক্তারের ভোটের হিসাব আরো কঠিন হয়ে উঠতো। শাহপরীরদ্বীপ ও উখিয়ায় তাহা ইয়াহিয়াদের পরিচিতি ও প্রভাব রয়েছে। মোহাম্মদ ইসহাকের বিষয়টি মানবিক হওয়ায় অনেকে এসব নিয়ে সরব থাকতেন। বাবা সাবেক এমএলএ অ্যাডভোকেট নুর আহমদের ও নিজের দলীয় পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে সোহেল আহমদ বাহাদুর চাপে ফেলতেন শাহীন আক্তারকে।
তবে, দীর্ঘ ৩ যুগেরও বেশি সময় উখিয়া-টেকনাফের ভোটের মাঠে বদি পরিবারের রাজত্ব। বদির পিতা মরহুম এজাহার মিয়া কোম্পানি একাধিক বার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ছিলেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও। ভোটের রাজনীতিতে এজাহার মিয়া কোম্পানি কখনও পরাজয়ের স্বাদ পাননি।
১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে ও ২০০১ সালে বিএনপির শাহজাহান চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হবার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা ছিল এজাহার মিয়া কোম্পানির।
বাবার রাজনীতির পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে মাঠে নামা বদি দলীয় ভোটে জড়ানোর আগে টেকনাফ পৌরসভার প্রথম প্রশাসক ও চেয়ারম্যান হন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হন দু’বার। চাচা মো. ইসলামকে টেকনাফ পৌর মেয়র, ছোটভাই মুজিবকে পৌর কাউন্সিল, শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীকে উখিয়ার রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান, সম্বন্ধি অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে জেলা পরিষদের সদস্য ও চাচা শ্বশুর অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীকে উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে জয়ী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন আবদুর রহমান বদি। এ কারণে এবারও তার এবং আওয়ামীলীগ নেতা নরুল বশরের কারিশমার ফল দেখতে ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে জেলাবাসীকে।
খবর ইত্তেফাকের
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-